ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরের শেষ ১৩ মিনিট

২১ জুলাই সোমবার দুপুর। ঢাকার আকাশে তখন এক নিদারুণ বিষণ্ণতা। উত্তরের মাইলস্টোন স্কুল প্রাঙ্গণ শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত, ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো যেন ছোট ছোট পায়ে ছুটোছুটি করছে। বাবা-মায়েরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাদের বুকের ধনদের ঘরে ফেরানোর জন্য। কিন্তু কে জানতো, এই সাধারণ দুপুরে এমনই এক মহাপ্রলয় অপেক্ষা করছে? কে জানতো, আকাশে উড়তে থাকা একটি প্রশিক্ষণ বিমান শুধু লোহার দণ্ড নয়, তাতে লুকিয়ে আছে এক অটুট প্রতিজ্ঞা, এক অবিশ্বাস্য আত্মত্যাগ?
বেলা ১টা ৬ মিনিট। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ‘এফ-৭ বিজেআই’ প্রশিক্ষণ বিমানটি যখন উড্ডয়ন করলো, তখন হয়তো পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর স্বপ্নেও ভাবেননি, এটাই তার জীবনের শেষ উড্ডয়ন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ৭৬তম ব্যাচের এই তরুণ পাইলটের এটি ছিল প্রথম একক মিশন – নিজের যোগ্যতা প্রমাণের, আকাশ ছোঁয়ার এক পরম আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। মাত্র ১৩ মিনিটের মাথায় বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো। তাকে বারবার ইজেক্ট করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল – নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ ছিল তার সামনে। কিন্তু তৌকির, তখন হয়তো ভাবছিলেন নিচের প্রাণের কথা, স্কুলের শত শত শিশুর কথা। তিনি জানতেন, ইজেক্ট করলে বিমানটি সরাসরি আবাসিক এলাকায় বা স্কুল ভবনে আছড়ে পড়বে, ধ্বংসযজ্ঞ আরও বাড়বে।
যে দৃশ্য এখন চোখের সামনে ভেসে উঠছে, তা কোনো কল্পকাহিনী নয়, এ এক চরম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তৌকির চেষ্টা করছিলেন বিমানটিকে যেন জনবসতিহীন এলাকায় নিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু বিমানের নিয়ন্ত্রণ তখন তার হাতে নেই। প্রতিটি মুহূর্ত যেন মৃত্যুর কাছাকাছি টেনে আনছে তাকে। শেষ মুহূর্তে, যখন বিমানটি মাইলস্টোন প্রিপারেটরি কেজি স্কুলের ভবনের ওপর আছড়ে পড়লো, তখন তিনি হয়তো শেষবারের মতো কিছু করার চেষ্টা করছিলেন। তার শেষ নিঃশ্বাস মিশে গেছে পোড়া কাঠ আর লোহার গন্ধে। নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করেননি। তার বুকের গভীরে ছিল একটিই প্রার্থনা – যেন আর কোনো শিশুর জীবন না যায়!
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথে যেন পুরো উত্তরা জুড়ে নেমে এলো এক ভয়াবহ নীরবতা, এরপরই শুরু হলো আহাজারি আর আর্তনাদ। এক নিমেষে স্কুলের ভবনটি পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে, চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। যে প্লে গ্রুপের শিশুদের কলকাকলিতে ভবনটি মুখরিত থাকতো, সেখানে এখন শুধুই চাপা কান্না আর বিভীষিকাময় আতঙ্ক। “মিস আমার বাচ্চা কই?” মোবাইল ফোনে চিৎকার করে কাঁদতে থাকা এক মায়ের আকুতি যেন হৃদয় বিদীর্ণ করে দেয়। শত শত বাবা-মা তাদের সন্তানদের খোঁজে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছেন, তাদের চোখের জল যেন যমুনার মতোই বয়ে চলেছে। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অর্ধশতাধিক দগ্ধ শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে, তাদের আর্তনাদ যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে এক শোকের মাতম তৈরি করেছে। ১৪ বছরের শামীম, ১৫ বছরের মাহিন, ১২ বছরের মুনতাহা, ১০ বছরের আয়মান – নামগুলো যেন শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি নামেই লুকিয়ে আছে এক একটি পরিবারের দুঃস্বপ্ন, এক একটি মায়ের অশ্রুভেজা ফোঁটা।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর, যিনি নিজের প্রথম একক মিশনেই আত্মোৎসর্গ করলেন, তিনি হয়তো শুধু একজন পাইলট ছিলেন না, ছিলেন এক নীরব প্রহরী। তার আত্মত্যাগ হয়তো হাজারো শিশুর জীবন বাঁচিয়েছে।